মলকা বানু-মনু মিয়ার অমর প্রেম উপাখ্যানের নায়ক মনু মিয়ার আসল নাম ছিল জবরদস্ত খাঁ। মনু মিয়ার স্মৃতি বিজড়িত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আনোয়ারা শোলকাটা গ্রামটি ঘিরে রয়েছে বহু পুরাকীর্তি, ঐতিহ্য ও পৌরাণিক কাহিনি। যার মধ্যে ইতিহাসের কিংবদন্তি জমিদার মনু মিয়ার ‘ষোল হত্যাকাণ্ড’ একটি অন্যতম ঘটনা বা কাহিনি।
জনশ্রুতি আছে, দেয়াঙ পরগনা তথা আনোয়ারার প্রভাবশালী ও অত্যাচারী জমিদার জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনু মিয়া দেওয়ান পরিবারের ১৬ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। সেই হত্যাকাণ্ড থেকেই এই গ্রামের নামকরণ হয় ‘ষোলকাটা’। পরবর্তী সময়ে তা লোকমুখে ‘শোলকাটা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
শোলকাটা তথা ষোলকাটা গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে বিখ্যাত কালা বিবির দিঘি, দক্ষিণে মনু মিয়ার বসতবাড়ি, মসজিদ ও দিঘি, পূর্বে রয়েছে
তত্কালে নির্মিত ছুরুত বিবি মসজিদ ও দিঘি। এ মসজিদের দক্ষিণ পাশে ষোল হত্যাকাণ্ডের ১২টি ছোট-বড় গণকবরের অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান।
ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিনের ‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আরাকান রাজসভার মহাকবি আলাওলের দ্বিতীয় কন্যা ছুরুত বিবি ওরফে শুক্কুর বিবির বিয়ে হয় দেয়াঙ পরগনার আরেক জমিদার শেখ রাজার বংশেরই পরবর্তী পুরুষ দেওয়ান আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে। তাদের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন জাফর খাঁ ও মোজাফফর খাঁ নামে দুই সন্তান। অসম্ভব বিনয়ী ও প্রজাবত্সল জমিদার হিসেবে এই দেওয়ান পরিবারের যথেষ্ট খ্যাতি ও সুনাম ছিল দিল্লির মোগল রাজদরবারেও। ফলে দিল্লির রাজদরবার দূত প্রেরণের মাধ্যমে ছুরুত বিবির দুই সন্তানকে দিল্লিতে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে নবাবী সনদ দেয়।
জাফর খাঁ ও মোজাফফর খাঁ দেয়াঙ পরগনায় এলে তাদেরকে হাজার হাজার জনতা যথাযথ সম্মান ও সংবর্ধনার মাধ্যমে সাদরে বরণ করে নেন। কিন্তু প্রভাবশালী ও অত্যাচারী জমিদার জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনু মিয়া ছুরুত বিবির দুই সন্তানের নবাবী সনদ পাওয়াকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। ছুরুত বিবির দুই সন্তানের জমিদারি পরিচালনায় প্রকাশ্যে ও গোপনে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকেন তিনি। নবীন দুই জমিদারের পক্ষে মনু মিয়ার এসব অন্যায় অপকর্মের প্রতিবাদ করার মতো সাধ্য ছিল না। কারণ সে সময় মনু মিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী নবাব ইয়াছিন খান।
কথিত আছে, নবাব ইয়াছিন খানের সহযোগিতায় মনু মিয়া ছুরুত বিবির দুই সন্তান জাফর খাঁ ও মোজাফফর খাঁকে ধরে নিয়ে যান। এরপর তারা আর কোনোদিন ফিরে আসেননি। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর দুই ভাইয়ের খণ্ডিত মস্তক চট্টগ্রাম নগরীর কাটা পাহাড় নামক পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয়।
পরবর্তী সময়ে দুই ভাইকে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে দেওয়ান পরিবার আক্রোশে ফেটে পড়ে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হিংস্র ও অত্যাচারী জমিদার মনু মিয়া দেওয়ান পরিবারের আরও ১৬ সদস্যকে ধারালো তলোয়ার দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে হত্যা করেন।
ঐতিহ্যবাহী ছুরুত বিবির মসজিদের দক্ষিণ পাশে সারি সারি কবর দেখিয়ে স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব আবুল ফয়েজ বলেন, এই কবরগুলো ছুরুত বিবি পরিবারের সদস্যদের। যাদেরকে মনু মিয়া হত্যা করেছিল। শুনেছি, এক সঙ্গে ষোলজনকে হত্যা করা হয়। এই ষোল হত্যাকাণ্ড থেকে আজকের এই শোলকাটা গ্রাম।
Posted by Newsi24